লক-ডাউন
– বর্ণালী জানা সেন
সকালে উঠেই মনটা তেঁতো হয়ে গেল শান্তনুর। আটটা বেজে গেল। এখনও এককাপ চা জুটলো না। সকালের চা- তার খুব তরিবতের…বেশি দুধ আর এলাচ আর তেজপাতা দেওয়া মশালা চা। চা-চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজে একটু চোখ বোলানো। এই তো তার একমাত্র বিলাসিতা। তা আজ চা-টাও জুটবে বলে মনে হয়না। রান্নার লোক ডুব দিয়েছে। কাগজওলাও কাগজ দেওয়া বন্ধ করেছে। শহর অবরুদ্ধ। লকডাউন। একুশ দিন থাকো গৃহবন্দী হয়ে। অফিস যদিও বলেছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। তাও! এই মহিলার সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকা! উফফ অসহ্য। এত বেলা হয়ে গেল তাও মহারানী ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছেন! পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ বেঘোরে মরছে তাও অদিতির কোনও হুঁশ নেই। জানার কোনও আগ্রহও নেই। শুধু নিজের ঠাকুর ঘর, তিনবার চান, তিরিশ বার ন্যাতা দিয়ে ঘর মোছা, আশি বার হাত ধোওয়া, আর বস্তাপচা টিভি সিরিয়াল নিয়েই দিব্যি আছে। ছেলেটার জন্যও কোনও চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। বিল্টু ব্যাঙ্গালোরে আটকে পড়েছে। ছেলেকে নিয়ে শান্তনুর চিন্তার শেষ নেই। অথচ, ছেলের মা-কে দেখো…নির্বিকার।
রান্নার মাসি আছে বলে সকালে চা আর দু’টো বিস্কুট জোটে। লাঞ্চ সে অফিসেই সেরে নেয়। আর রাতে নীনার বাড়ি থেকে ডিনারটা সেরেই বেরোয়। অদিতির খাওয়ার কোনও থিক-ঠিকানা নেই। খই-মুড়ি খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারে দিনের পর দিন। কিন্তু শান্তনু কী করবে। একটু ভালো-মন্দ নাহলে যে তার মুখে রোচে না। ছোটবেলায় মা-যে শুক্তোটা করত…আহ্…জিভে, টাগড়ায় এখনো তার স্বাদ লেগে আছে। একদিন অদিতিকে বলতেই এমন ঝাঁঝিয়ে উঠল!… ‘ বড্ড নোলা বেড়েছে। হোটেল থেকে আনিয়ে নাও। আমি পারব না’।
আর রান্নার মাসির সঙ্গে কী যে দুর্ব্যবহার করে, তা আর কহতব্য নয়। কাপড় ছেড়ে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে। মশলাপাতির কৌটোগুলো সাবান দিয়ে ধুতে হবে। দশবার টেবিল মুছতে হবে। একমাত্র সবিতাদি বলেই টিকে আছে। অনেক দিনের লোক তো! শান্তনুর ওপর কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে।
এই মহিলার জন্য হাড়মাস কালি হয়ে গেল শান্তনুর। কথায় কথায় মুখঝামটা। কোনওকিছু মনের মতো না হলেই একেবারে রণরঙ্গিনী…কাপ, ডিশ ভাঙচূর। শান্তনুও আজকাল ঝামেলায় যায় না। সুখের চেয়ে বাবা স্বস্তি ভালো। আজকাল আর কথা বলতেই ইচ্ছে করে না অদিতির সঙ্গে। বিছানায় পাশে শুয়ে তার গা ঘিনঘিন করে। শরীর তো কবেই চলে গেছে তাদের সম্পর্ক থেকে…মনও।
রাস্তাঘাটে নিয়ে আজকাল অদিতিকে নিয়ে বেরোতে লজ্জা হয়। সেদিন সবজির কিনতে গিয়ে দু’টো টাকার জন্য দোকানিকে এমন গালাগালি শুরু করল যে লজ্জায় শান্তনুর মাথা কাটা যায়! এত নামী ওষুধ কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজারের বউকে এটা শোভা পায় না। সংসার থেকে একেবারে মন উঠে গেছে শান্তনুর। শুধু কলের পুতুলের মতো দায়িত্ব পালন করে যাওয়া। ছেলেটার কথাও তো ভাবতে হবে। ইচ্ছে করে অফিসেই কাটিয়ে দেয় বেশির ভাগ সময়। সবাই বাড়ি চলে যাওয়ার পরেও সে বসে থাকে কেবিনে। আর কিছু করার না থাকলে বসে বসে নেটসার্ফ করে, বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে। তাও বাড়িমুখো হয় না। বাড়ি নাকি নরক! নীনা অনেক বার বলে… ‘স্যার অনেক রাত হল। এবার বাড়ি যান’। জীবনে যেটুকু পাওনা বাকি আছে নীনাই তাকে দিয়েছে। শান্তনুর ড্যাশিপুশি এই সেক্রেটারির মধ্যে আগুন রয়েছে। সেই আগুনে শান্তনুও ঝাঁপ দিয়েছে। এটা যেন অনিবার্য ছিল। জীবনে একটু পাওনা আদায় করে নিলে ক্ষতি নেই।
সাড়া দিয়েছে নীনাও। ওপরে ওঠার তার বড্ড তাড়া। এরিয়া ম্যানেজারকে রসে বশে রাখার কোনো কসুর সে করে না। নীনার ফ্ল্যাটেও শান্তনুর অবাধ যাতায়ত। মদের গেলাসে…বিছানায় দানা বাঁধে তাদের সম্পর্ক। অফিস ট্যুরের নাম করে তারা কোভালাম গেছে, সিমলা গেছে। সমুদ্রের তীরে বসে হাত ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছে। পাহাড়ের ঠান্ডায় একে অপরকে উষ্ণতায় ভরিয়ে দিয়েছে। সে তো কয়েক মুহূর্তের চুরি করা সুখ। তারপর আবার সেই পুরোনো একঘেয়ে জীবন।
আজ অদিতির থলথলে চেহারাটার সঙ্গে প্রথম যৌবনের অদিতিকে সে মেলাতেই পারেনা। অদিতি তো বরাবর এমন অবুঝ খিঁটখিটে ছিল না। মা-বাবাই সম্বন্ধটা করেছিলেন। মা চেয়েছিলেন ঘরোয়া মেয়ে…যে মন দিয়ে সংসার করবে। শান্তনুরও আপত্তি ছিল না। অদিতিকে অপছন্দ করার মতো কিছু ছিল না। শিখরদশনা না হলেও তন্বী, শ্যামা তো বটেই। মিষ্টি একটা মেয়ে। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, ঝকঝকে হাসি। শান্তনুও এমন কিছু আহামরি চাকরি করতো না। সামান্য মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ। অল্প মাইনে। কিন্তু তার মধ্যেই সংসারটাকে কেমন দিব্যি চালিয়ে নিত অদিতি। শ্বশুর, শাশুড়ির সেবা…শান্তনুর হাজারো বায়ানাক্কা সে হাসিমুখেই মেটাতো। বাড়ি ফিরেই তখন গরম গরম আলুর পরোটা…পকোড়া। রান্নার বই দেখে কতরকমের যে এক্সপেরিমেন্ট করতো অদিতি। আর শান্তনু গিনিপিগ। ছুটির দিনে তারা সিনেমায় যেত, অ্যাকাডেমিতে যেত নাটক দেখতে। তারপর তো বিল্টু এল। ছেলেকে নিয়েই তখন অদিতির জীবন। বিল্টুর স্কুল, কোচিং ক্লাশ, সাঁতার, আঁকার ক্লাশ। শান্তনুর কেরিয়ারও দৌড়ে চলল। সংসারের জন্য সময় কমলো। সকালে নাকে মুখে দু’টো গুঁজেই কোনও রকমে দৌড়। বেরোনোর সময় টাই খুঁজে দেওয়া, লাঞ্চ বক্স ধরিয়ে দেওয়া কোনও কিছুতেই ত্রুটি ছিলনা অদিতির। তার পর বাবা-মা চলে গেল। বিল্টুও চলে গেল বাইরে পড়তে। সংসারে তখন শুধু দু’টো মাত্র প্রাণী। থম মেরে গেল অদিতি। শান্তনু প্রথমে ভেবেছিল ছেলের জন্য হয়তো মন খারাপ!
এত খাটা-খাটনি কি শান্তনু নিজের জন্য করে? ভাড়া বাড়ি ছেড়ে এই পশ এরিয়ায় ফ্ল্যাট, গাড়ি—কী সে দেয়নি অদিতিকে। কিন্তু অদিতির মন পায়নি। সারাদিন সে বাইরে থাকে…অদিতির যাতে একা না লাগে তার সব ব্যবস্থাই করেছে…বইপত্র, দেওয়াল জোড়া এলসিডি, বোসের মিউজিক সিস্টেম। অদিতি ওসব ছুঁয়েই দেখেনি। একটা খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
ব্যাপারটা ধরা পড়েছিল অনেক পরে । অনেক দিনের ফাইব্রয়েড। হিস্টেরেকটমিটা করতেই হবে। এই বিষটাকে কতদিন শরীরে পুষে রেখেছিল কে জানে! অপারেশনের পর দু-দিনের বেশি শান্তনু বাড়ি থাকতে পারেনি। অফিসে এত চাপ! ইয়ার এন্ডিং! বাড়িতে সারাক্ষণ আয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
শরীর সেরে গেল। কিন্তু পুরোনো অদিতি আর রইলো না। খিঁটখিঁটে মেজাজ। সারাক্ষণ চেল্লামেল্লি…অশান্তি। নীনার ফ্ল্যাটে শান্তনুর আনাগোনা বাড়ে। অন্য জগত গড়ে ওঠে জীবনে। এখন একুশ দিন! অতদিন নীনাকে না দেখে থাকবে কী করে! মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে।
ওদিকে অদিতির কোনও হুঁশ নেই। মানুষ কী করে যে অত ঘুমোতে পারে! ঘুমের ঘোরে একবার পাশ ফেরে অদিতি। ঘুমন্ত অদিতির মুখটা একবার ভালো করে দেখে শান্তুনু। তার ছাব্বিশ বছরের সঙ্গী! এই পঞ্চাশেই একেবারে বুড়িয়ে গেছে। মুখে ভাঁজ। চোখের কোণে কালি! অথচ শান্তুনু। এই পঞ্চান্নতেও চির যুবক। এখনও সে অনেক মেয়ের বুকে কাঁপন ধরাতে পারে। নীনা তো মাঝে মাঝেই বলে… ‘হাউ ডু ইউ ম্যানেজ টু বি সো…ইয়ং’। অদিতির দিকে আজ সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। আজ আর অদিতিকে অত কুচ্ছিত লাগছে না। মুখে এখনও সেই সারল্য… যেমনটা ছিল পঁচিশ বছর আগে। চুলে পাক ধরলেও এখনও যেন সেই লজ্জা রাঙানো নতুন বউ। এভাবে অদিতিতে অনেক দিন দেখেনি। কতদিন যে দু’জনে একান্তে কথা বলেনি! শান্তনুর সময় কোথায়! আর যেটুকু সময় পায় সেটুকু নীনার। কয়েকদিন ধরেই একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে অদিতি। বাতের ব্যাথাটা কি তবে বেড়েছে! কে জানে। মহারানী তো মুখ ফুটে কিছু বলে না। না না অনেক দিন হল। ডাক্তারটা একবার দেখিয়ে নেওয়া দরকার।
হিস্টেরেক্টমির পরে ডা.সাধুখাঁ সাবধান করে দিয়েছিলেন… ‘দেখুন মি.বাসু এই সময়টা কিন্তু খুব ক্রিটিক্যাল। শরীর সেরে যাবে। কিন্তু এই সময় মেয়েদের কিন্তু অনেক সমস্যা হয়। ভীষণ মুড সুইং হবে। অকারণে রেগে যাবে। আপনাকে কিন্তু মিসেস বাসুকে খুব
যত্নে রাখতে হবে। আপনাকে বোঝাতে হবে যে শুধু জরায়ুটা গেছে। কিন্তু ওনার প্রতি আপনার ভালোবাসা একটুও কমেনি। এই আশ্বাসটা ওনার পাওয়া দরকার’। শান্তনু মাথা নেড়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করেনি। শুধু দু’বেলার আয়া রেখে দায়িত্ব সেরেছিল। সত্যিই তো সেই কঠিন সময়ে সে অদিতির পাশে থাকেনি। মাঝরাতে নীনার ফ্ল্যাট থেকে ফিরে বউয়ের মাথায় একটুও হাত বুলিয়ে দেয়নি। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখত অস্থির হয়ে ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে অদিতি। চোখে ঘুম নেই। তারপর থেকেই একটু একটু করে বদলে গেল অদিতি! কোনও কিছুতেই মন নেই। হেলদোল নেই। শান্তনু কি একেবারেই সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারে? শান্তনুও তো কোনদিন অদিতির কষ্টের কথা ভেবে দেখেনি। সম্পর্কটাকে সেও তো ঘষামাজা করেনি। শুধু অভ্যেসের বসে এক ছাদের নীচে থাকা।
অনেক কথাই মনে ভীড় করে আসে শান্তনুর…তাদের হানিমুনের কথা। হাতে পয়সাকড়ি ছিল অল্প। তাই দীঘা! আজ শান্তনুর বিদেশ ট্যুর লেগেই থাকে। ইচ্ছে করলেই অদিতিকে নিয়ে যাতে পারে। কিন্তু সে প্রবৃত্তি হয় না। বাইরের সমাজে মেশার যোগ্য নয় অদিতি।
আজ সেই পুরোনো অদিতির জন্য মনটা কেমন করছে। বেচারা সারা রাত জেগে হয়তো ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। তা একটু ঘুমোক। আজ তো কোনও তাড়া নেই।
জীবনে প্রথমবারের মতো রান্নাঘরে ঢোকে শান্তনু। সেলফ থেকে কৌটো হাতড়ে এলাচ, তেজপাতা বের করে। তারপর সসপ্যানে দু-কাপ জল চড়িয়ে দেয়! আজ সকালের চা-টা
নাহয় একসঙ্গেই হোক।
খুব খুব মন মুগ্ধকর একটি গল্প, রচনার অনন্য ভঙ্গিতে লেখার মাধুর্জ্য বেড়ে গেছে ।